দীঘা (প্রথম পর্ব)


কোথায় যে যাই… ভেবে না পাই…

“ধুর ধুর ! ভাল্লাগেনা আর !”, বলেই অনুষ্কাদি কি-বোর্ড টা একপাশে ঠেলে সরিয়ে দিল। “যত রাজ্যের boring কাজ আমার ঘাড়ে, কেন যে মরতে ম্যানেজারকে বলতে গেলাম, দোলে বাড়ি যাব না !”, এবার একরাশ বিরক্তি গলায়।

“মানে এবারও ডকুমেন্টেশন তোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে, তাই তো? নাও, এবার সামলাও ঠেলা !”, কম্পিউটারের স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়েই ফোড়ন কাটলো শোভনদা।

“শোভন, মার খাবি এবার! খুব মজা লাগছে না ? তোর জন্যেই তো !”, কটমট করে তাকিয়েছে অনুষ্কাদি।

“যাঃ বাবা, ও কি করলো ?”, প্রীয়মদা আর ঋষি এগিয়ে এসেছে কমরেডের বিপদ বুঝে।

“ওর জন্যই তো। কতদিন ধরে  বলছি, দোলে একটা কোথাও ঘুরে আসবার প্ল্যান কর, তা বাবু নাকি এবার পাড়ায় দোল খেলবেন বলে কোথাও যাবেন না। ওই একদিনের দোলের ছুটিতে কি আমি সেই রায়গঞ্জ যাব, বাড়ি ?”, গজ গজ করতে করতে বললো অনুষ্কাদি। “আর ম্যানেজারটাও তেমনি, যেই শুনেছে এবার বাড়ি যাচ্ছি না, ধরিয়ে দিয়েছে যত রাজ্যের বাজে কাজ”।

“কি আর করা যাবে, কোথাও যখন যাবার প্ল্যান করে উঠতে পারলে না এতদিনে, এবার বসে বসে কলম, থুড়ি কি-বোর্ড চালাও”, রিমা বললো কানের থেকে হেডফোন খুলতে খুলতে। 

“আরে, আমি কি আটকাচ্ছি নাকি ? তোরা যা না ঘুরে আয়”, শোভনদা উদার হবার চেষ্টা করে।

“হ্যাঁ, এখন তো শোভন বলবেই! পুরো দুটো সপ্তাহ ধরে বসে থাকলো সবাই কোনো প্ল্যান না করে। আর আজ অলরেডি বুধবার। কোথাও টিকিট বা হোটেল পাবি এখন ?“, সুমনদাও বেজায় খাপ্পা হয়ে আছে শোভনদার ওপর।

“একদম বাজে কথা বলবে না শোভনদা! তুমি যাবে না আর আমরা সবাই ঘুরতে যাব?”, রিমাও উঠে এসেছে ওর ডেস্ক থেকে।

“ছাড় তো, তোরা শুধু একটা কোথাও ঘর বুক করে দে। আমি একাই ঘুরে আসবো। চুলোয় যাক ডকুমেন্টেশন !”, অনুষ্কাদি সিরিয়াস।

IT সেক্টরের আপিসে গড়পরতা কাজের দিনের খুব সাধারণ ছবি। এবারের মার্চে দোলের ছুটি শুক্রবার, মানে শনি রবি মিলিয়ে সেই long-weekend যার জন্যে চাতক পাখির মত বসে থাকি আমরা IT-ভাইটি রা। সাধারণত লম্বা ছুটি পড়লে কেউ আর বাড়ি বসে থাকে না। কিন্তু এইবারের ছুটিটা জলে যেতে বসেছে বলে মন খারাপ করে বসে আছি। শোভনদা আর অনুষ্কাদি আমাদের ট্যুর প্ল্যানার, কিন্তু দুজনেই বিশেষ কোনো উত্সাহ না দেখানোয় দোলের ছুটিটা মাঠে মারা গেল বলেই ধরে নিয়েছি আমরা। আমরা মানে আমার অফিসের বন্ধুরা। যদিও খাতায় কলমে সব্বাই আমার colleague, কিন্তু কিছুতেই সেটা মনে থাকেনা। সবাই এখন আমার দাদা, দিদি আর বন্ধু। অনুষ্কাদির কথায় এবার আমার মুখে একটা হাসি খেলে গেল। একটা প্ল্যান অনেকক্ষণ থেকে ঘুরছে মাথায়। জয় গুরু !

টুকটুক করে অনুষ্কাদির পাশে এসে বললাম, “চলো না, তাহলে না হয় দীঘা থেকেই ঘুরে আসি?”

কয়েক সেকেন্ডের নিরবতা, তারপরই হই হই করে উঠলো অনুষ্কাদি, রিমা, প্রীয়মদা আর সুমনদা। “একদম সহি বাত ম্যাডাম, দীঘা হি চলেঙ্গে।”, পবনও যোগ দিয়েছে শুনে। “কিন্তু হোটেল ? মানে, এতগুলো রুম পাওয়া যাবে এখন ?”, মিনমিন করে বলতে যাচ্ছিলো ঋষি। “থাম তো! খুঁজলে বাঘের দুধও পাওয়া যায়, তো দীঘার হোটেল!”, সুমনদা ওকে চুপ করিয়ে দিয়েছে তৎক্ষনাৎ।

“ধুস, দীঘা তো বাঙালি চল্লিশবার যায়!”, শোভনদা আমতা আমতা করে একবার বলার চেষ্টা করলো।

“বেশ, তোর নিশ্চই চল্লিশবার হয়নি এখনো? এবার আমাদের সাথে গিয়ে কাউন্টটা এক বাড়িয়ে নিবি”, অনুষ্কাদি আর ছাড়বে না সহজে।

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, দোলটা নাহয় এবার দীঘাতে গিয়েই খেলবো শোভনদা”, আমি ছোট্ট করে জায়গামতো জুড়ে দিয়েছি।  শোভনদা বুঝে গিয়েছে আর এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। অতঃপর আড় চোখে একবার অনুষ্কাদির মুখটা দেখে নিয়ে বললো, “ওকে, তাহলে দীঘা…”।

“ব্যাস, হয়ে গেল ফাইনাল। চল চল অনেক কাজ করতে হবে। আগে হোটেল ঠিক করি। তারপর গাড়ী, সুমনদা তৎপর। “এখন বড় গাড়ী হয়ত আর পাবো না”, শোভনদার মুখ ব্যাজার। “অগত্যা ধর্মতলা থেকে বাস! ভালই হবে, কতদিন বাসে চড়িনি”, রিমা একপায়ে খাড়া। ঠিক হলো রবিবার সকাল ৭টায় ধর্মতলা বাস ডিপোতে আসবো সবাই।

অবশেষে ১৫ই মার্চ, ২০১৪ তে আমরা রওনা হলাম। অনুষ্কাদি – শোভনদা, প্রীয়মদা, সুমনদা, পবন, ঋষি, রিমা আর আমি – আমরা আট জন।

Bye Bye কলকাতা… 

যথা সময়ে আমরা পৌঁছে গেলাম ধর্মতলা। কিন্তু পৌঁছে তো সব্বার মাথায় হাত – অজগরের মত এঁকেবেঁকে বিশাল লাইন চলে গিয়েছে প্রতিটি কাউন্টার থেকে। প্রচুর মানুষ অপেক্ষা করছেন আমাদেরই মতো বাস এর জন্য। তিন দিনের ছুটি, বাঙালিকে আর আটকায় কে ?  কিন্তু এই লাইনে দাঁড়ালে সন্ধ্যার আগে দীঘা পৌঁছানো অসম্ভব, ছুটির একটা দিন পুরোটাই মাটি। এখন উপায়? পথ বাতলালো শোভনদা। কোত্থেকে একটা আট সিটের গাড়ী ঠিক খুঁজে নিয়ে এসেছে প্রীয়মদার সাথে। ধন্য আমাদের ট্যুর প্ল্যানার! সেই গাড়ীটাই রিজার্ভ করে আমরা রওনা হলাম দীঘার উদ্দেশ্যে। “চলো, let’s go”, ঘোষণা করলো অনুষ্কাদি, তার মুখে হাসি আর ধরে না তখন।

হাল্কা শীতের আমেজ একটু আছে এখনও, সকালের সেই ঘুম জড়ানো পথ ধরে আমরা এগিয়ে চললাম। গাড়ীর জানলা দিয়ে দেখলাম আস্তে আস্তে আড়মোড়া ভাঙছে শহর কলকাতা। কোথাও ময়দানে ঘোড়া ছুটিয়ে সকালের গা-গরমের প্রস্তুতি, কোথাওবা মা-বাবার হাত ধরে ঘুম চোখে খুদে পায়ের হাটাহাটি, কোথাও আবার ক্রিকেট ব্যাট হাতে বা ফুটবল পায়ে ছেলেদের ছোটাছুটি, কোথাওবা ঝালমুড়িওলার হেঁটে চলা পসরা খুলে বসার তাগিদে, আবার কোথাও চা ওলার সকালের চা তৈরির তোড়জোড়। এভাবেই রোজকার রুটিনে ব্যস্ত কলকাতার পথ ধরে গাড়ী ছুটে চললো দীঘার দিকে। পিছনে পড়ে রইলো আমার শহর।

কেক বিস্কুট কিনেই গাড়ীতে উঠেছি। চলতে চলতে টুকটাক মুখ চলছে আমাদের। আর সাথে চলছে টক ঝাল মিষ্টি গল্প, এর ওর পিছনে লাগা, হালকা হাসিঠাট্টা। দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম কোলাঘাট। সকালের জলখাবার খেতে কেউই তেমন উৎসাহী নই। তাই গাড়ী আর না দাঁড়িয়ে ছুটল NH-6 ধরে। ঘন্টাখানেক পরেই পৌঁছে গেলাম কাঁথি। কাঁথি থেকে বাঁদিকে দীঘা-কন্টাই রোড ধরে গাড়ী এগিয়ে চললো চাউলখোলার দিকে। চারিদিকে সবুজ়ে ভরা মাঠ আর হলুদ-সবুজে ছককাটা জমিতে ব্যস্ত চাষীরা। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। গাড়ীর ভিতরে চলছে অন্তাক্ষরী। আস্তে আস্তে আমরা ঢুকে পড়ছি শহরের মধ্যে। হঠাৎ দেখলাম বড় বড় দানার আঙ্গুরের পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানে। লোভ সামলানো যায় নাকি ? গাড়ী দাঁড় করিয়ে নেমে পরলাম সবাই। আঙ্গুর কিনে আর ডাবের জলে গলা ভিজিয়ে আবার শুরু হলো পথ চলা। চাউলখোলা থেকে সোজা এগিয়ে বালিসাই হয়ে আমরা ঢুকে পড়লাম ওল্ড দীঘার পথে। গন্তব্য হোটেল লারিকা ইন। হোটেলটি ওল্ড দীঘা আর নিউ দীঘার মাঝামাঝি। অবশেষে আমরা যখন হোটেলে পৌঁছলাম তখন বেলা প্রায় সাড়ে ১১টা।

অবশেষে দীঘা

Hotel Larica Inn সঙ্গে আমাদের টিম

হোটেলে পৌঁছে কিছুক্ষণের বিশ্রাম। পেটে ততক্ষণে ছুঁচো ডন-বৈঠক দিচ্ছে সবার। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে আমরা ঠিক করলাম খেতে যাব ওল্ড দীঘায়। আসলে হোটেল আর খাবার দোকানগুলো এখনো বেশিরভাগই ওল্ড দীঘাতে। হোটেল লাগোয়া রেস্টুরেন্ট থেকে সাধারণ মাছভাতের দোকান, সবই আছে। তবে দোকানগুলির সাদামাটা চেহারা দেখে ভুল করবেন না, চিংড়ি, কাঁকড়া, হরেক মাছ থেকে শুরু করে চিকেন মাটন, সবই পাওয়া যাবে। এইরকমই একটা হোটেলে বেশি ভিড় নেই দেখে ঢুকে পরলাম আমরা। সবাই একটা করে ভাত ডাল সব্জির প্লেট নিয়ে নেওয়া গেল, সাথে পছন্দমতো মাছ আর মাংস। পবন আবার প্রথমবার এসেছে সমুদ্রে বেড়াতে। প্রীয়মদার প্লেটের চেয়ে দেড়গুন বড় সাইজের পাবদা আর ঋষির প্লেটের বাইরে ঝুলতে থাকা পমফ্রেট দেখে জুল জুল করে তাকিয়ে আছে। “ভাই, ইতনি বড়ি মছলী ক্যায়সে খা লেতে হো ?”, আর থাকতে না পেরে বলেই ফেললো বেচারা। আমরা অবশ্য কেউই উত্তর দেওয়ার বিশেষ উৎসাহ দেখালাম না, হাত আর মুখ দুটোই তখন সমান ব্যস্ত। রিমা নিয়েছে গুরজালি, অনুষ্কাদি, শোভনদা আর সুমনদা ভাগাভাগি করে নিয়েছে কয়েক প্লেট পার্শে, ভেটকি আর চিকেন। আমিও মন দিয়েছি চিকেন কষায়।  

জল কেলি

খাওয়া শেষে প্রীয়মদার দাবি, আজই সমুদ্রে স্নান করতে হবে। কারণ, হাতে মাত্র একটা গোটা দিন, আর কাল আমাদের তালসারী যাবার প্ল্যান। যেমন ভাবা তেমন কাজ। একসেট করে জামাকাপড় সাথে নিয়েই বেড়িয়েছি সবাই। কাজেই কোনো বাধা নেই। হোটেলের বিল কোনমতে মিটিয়েই আমরা চলে এলাম একছুটে সমুদ্রে।

জলকেলি

দীঘার সমুদ্রে এই সময় তেমন ঢেউ নেই। ওল্ড দীঘা বিচের অনেকটাই এখন পাথরের বোল্ডার ফেলা। স্নান করতে হলে এগিয়ে যেতে হবে বিচ ধরে কিছুটা। প্রীয়মদা আবার সমুদ্র অন্ত প্রাণ। পবনও কম যায় না। দুজনে মিলে জলে নেমে সেকী হুটোপুটি! আর পাড়ে দাড়িয়ে আমরা হেসে বাঁচিনা! দীঘার সমুদ্রের এই শান্ত রূপটাই আমার বড় ভালো লাগে। পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ। দাঁড়িয়ে থাকলে সর সর করে পায়ের তলা থেকে সরে যাচ্ছে বালি। নোনা হাওয়া এলোমেলো করে দিছে চুল। ছুটির দিনে বেশ ভালই ভিড় হয়েছে। ইচ্ছা করেই হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম একটু দুরে। ক্যামেরাবন্দী করে নিলাম কিছু দৃশ্য।

প্রথমবার দীঘায় এসে পবনের খুব উৎসাহ। বিচের ধারে ঘোড়া চড়তে দেখে সে তো আবদার করেই বসেছে, ঘোড়া চড়বে। দেখাদেখি লাফিয়ে উঠেছে রিমাও। তা ইচ্ছে যখন হয়েছে তখন মেটাতে তো হবেই! উঠে পড়ল পবন আর রিমা ঘোড়ার পিঠে। এদিকে অনেকক্ষণ হেঁটে আর জলকেলি করে সবার গলা শুকিয়ে এসেছে। কিন্ত জলের বোতল তো আনা হয়নি! আরে, ট্যুর ম্যানেজার থাকতে চিন্তা কিসের? অনুষ্কাদি ততক্ষণে দেখে নিয়েছে সমুদ্রের ধারে বিক্রি হচ্ছে কচি কচি ডাব। সাথে বিশেষ ব্যবস্থা, ডাব কিনে খেলে সামনে পাতা চেয়ারে বসা ফ্রি! স্নান সেরে তখন আমরা সবাই খুব ক্লান্ত। তাই ডাব হাতে নিয়ে বিচে পাতা কিছু চেয়ারে জমিয়ে বসলাম আমরা, চললো আড্ডা। সূর্য ততক্ষনে ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। দিগন্ত পরিবৃত জলরাশি তখন লালে লাল।

রাতের সমুদ্র

সূর্যাস্তের পরে ফিরে আসতেই হলো একবার হোটেলে, জামাকাপড় পাল্টাতে। যদিও মনে মনে ভাবছিলাম সূর্যাস্ত তো দেখলাম, কিন্তু রাতের সমুদ্র দেখবো না ? আকাশে তখন উঁকি দিয়েছে গোল থালার মতো চাঁদ। ম্যাজিক! একেই কী বলে টেলিপ্যাথি? কথাটা ভাবার সাথে সাথেই অনুষ্কাদি বলে উঠলো, “কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে! কাল পূর্নিমা, আজ রাতে সমুদ্রের ধারে বসে বসে চাঁদ দেখবো সবাই”। সবে সন্ধ্যা নেমেছে, হাতে তখনও অনেক সময়। আর রাতের খাবার খেতে সেই ওল্ড দীঘাতেই যেতে হবে। আমরা তাই আবার চললাম সমুদ্রের দিকে।

রাস্তায় যেন লোকের মেলা বসে গেছে। এই আমার প্রথম দোলের ছুটিতে দীঘায় আসা। ধারনাই ছিল না দোলের সময় দীঘায় এত ভিড় হতে পারে। রংবেরংএর আলোতে ভরে উঠেছে চারদিক। রাস্তার ধারে হাজারো দোকান, থরে থরে সাজানো আছে কাজু বাদাম, কিসমিস, নানান সামুদ্রিক মাছ। আছে কাঁকড়া, গলদা চিংড়ি, পমফ্রেট। চাইলেই একদম গরম ভেজে দিয়ে দেবে হাতে হাতে। আরো আছে ঝিনুক দিয়ে তৈরী নানা রকমের ঘর সাজানোর জিনিস। থাকে থাকে সাজানো নানা মাপের ও রংএর শাঁখ। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। আমরা সব দোকান ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম, ইচ্ছামত কিছু কেনাকাটাও সেরে ফেলা হলো।

এরমধ্যে রিমার আবার খুব ইচ্ছা, বন্দুক দিয়ে বেলুন ফাটাবে। সেটাই বা আর বাদ যায় কেন? কিন্তু তাই বলে রিমা যে এতবড় বন্দুকবাজ সেটা তো জানাই ছিল না! তিন রাউন্ড বন্দুক চালিয়ে রিমার স্কোর ১৭/১৮! এবার থেকে সামলে চলতে হবে দেখছি! বন্দুকবাজি শেষ হলে আমরা আবার পা বাড়ালাম বিচের দিকে। চলতে চলতে পথে ফুচকা ঝালমুড়ির দোকান। আরে বাবা বাঙালি তো, এসব আবার ছাড়া যায়? তাই ফুচকা ঝালমুড়ি খেয়ে অবশেষে আমরা এসে বসলাম সমুদ্রের পাড়ে।

সেই অপার জলরাশির মাঝে তখন শুরু হয়েছে চাঁদের আলোর খেলা। চরাচর ধুয়ে যাচ্ছে দুধসাদা জ্যোৎস্নায়। চোখ ফেরানোই দায়। গুন গুন করে গান ধরেছে ঋষি আর পবন। ইচ্ছা করছিল বসেই থাকি, হারিয়ে যাই সেই মায়াবী আলোর সমুদ্রে। এভাবে কতক্ষণ কেটে গিয়েছে জানিনা। চমক ভাঙলো শোভনদার ডাকে, “ওরে, তোরা খেতে চল! রাত প্রায় ৯ টা বাজতে চললো, হোটেলে ফিরে শুতে হবে জলদি। কাল সকালে Sunrise দেখবো তো”। অগত্যা উঠে পড়তে হলো। ডিনার এর কথা উঠতেই শোভনদা আর প্রীয়মদা টগবগিয়ে উঠেছে। আয়োজনের দায়িত্ব ওদেরই কিনা! আর ডিনারের ব্যবস্থাও হলো একদম লা জবাব – কি নেই আমাদের মেনুতে! ভাত ডাল রুটি সব্জি তো আছেই, তার সাথে যোগ দিয়েছে কাঁকড়ার ঝোল আর গরম গরম মটন কষা। খাবার প্লেটে রান্না করা কাঁকড়ার সাথে সেই আমার প্রথম সাক্ষাৎ। একটা কাঁকড়ার আস্ত ঠ্যাং তুলে তো নিয়েছি, কিন্তু কিছুতেই ঠিক বাগে আনতে পারছি না। এদিকে সবাই কাঁকড়া শেষ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে কচি পাঁঠার উপর। আমার ল্যাজেগোবরে অবস্থা দেখে বোধহয় মায়া হলো অনুষ্কাদির, ওই দেখিয়ে দিল কিভাবে খোলস ছাড়িয়ে বের করে আনতে হয় কাঁকড়ার নরম মাংস। হাত চালালাম দ্রুত, পাঁঠার মাংস নইলে একটুও পড়ে থাকবে কিনা সন্দেহ!

এবং ভুতের গল্প… 

হোটেলে ফিরতে ফিরতে ঘুমে ঢুলে আসছিল সবার চোখ, সেই সকাল থেকে চলছে ছোটাছুটি। প্রথমে আমরা সবাই ভাবলাম ঘুমোতে যাব। কিন্তু বেড়াতে এসে ঘুমলে চলে ? আমি আড্ডা মারার মেজাজে। প্রীয়মদাও দেখলাম এক পায়ে রাজি। অনুষ্কাদি শোভনদাও যোগ দিয়েছে। বেশ একটা গল্পের মেজাজে সবাই। পবন এবার খুলে বসলো ওর গল্পের ঝুড়ি। রাতের অন্ধকারে ঘরের ঢিমে আলোয় ও শুরু করলো এক ভূতের গল্প। “এত রাতে ভূতের গল্প?”, আমি আমতা আমতা করে একটু প্রতিবাদের চেষ্টা করলাম। এসব ভূত-টুত ঠিক ভালো লাগে না আমার! কি দরকার বাপু, এত রাতে তেনাদের নাম নেওয়ার? এরপর আর ঘুম আসবে কিনা কে জানে! কিন্তু বাকিদের প্রবল উৎসাহে আমার আপত্তি ধোপে টিকলো না বেশিক্ষণ। পবন আরো জাঁকিয়ে বসলো ওর হানাবাড়ির গল্প নিয়ে। কী ভয়ানক সে গল্প! শুনতে শুনতে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল রীতিমত। উপায়ান্ত না দেখে আমি তো রিমার হাত ধরেই বসে আছি। বেশ বোঝা যাচ্ছে, বাকিদের অবস্থাও খুব একটা সুবিধের নয়। হটাৎ ঢং ঢং করে একটা বিকট আওয়াজ! চমকে উঠে পড়েই যাচ্ছিলাম বোধহয় খাট থেকে। “খুকি সত্যি ভয় পেয়েছে রে”, ফিক ফিক করে হেসে বললো সুমনদা। “মোটেও ভয় পাইনি আমি”, প্রতিবাদ করলেও নিজের গলাটাই কেমন যেন অচেনা শোনালো আমার! এত রাতে কে আবার এমন আওয়াজ করে? “আরে ধুর, ও তো হোটেলের ঘড়ির ঘন্টা”, একটুও না ঘাবড়ে বললো রিমা। সত্যি সাহস আছে মেয়েটার! রাতঘড়ি জানান দিল ২টো বেজে গিয়েছে। অনুষ্কাদি বললো, “আর না, চল ঘুমাতে যেতে হবে। নইলে কাল Sunrise কিন্তু miss!”

জাগরণে যায় বিভাবরী

একটু পরে শুয়ে পড়লো কয়েক জন। রাত তখন প্রায় আড়াইটে। জেগে রইলাম আমি, রিমা, প্রীয়মদা, সুমনদা আর ঋষি। কিন্তু ঘুম যে আর দেখা দেয় না! চোখ বুজলেই মনে আসছে পবনের গল্পের ভূতটার কথা। এদিকে পবন নিজে দিব্বি নাক ডাকিয়ে ঘুম লাগিয়েছে। আমরা কজন খালি বসে বসে ভাবছি, বাকি রাতটা কিভাবে কাটবে। “চল গান গেয়েই কাটিয়ে দিই”, প্রস্তাব করলো মুসকিল-আসান প্রীয়মদা। এমন লোভনীয় সুযোগ আর ছাড়া যায়! ভূতের ভয়, গান দিয়েই করবো জয়! তাই শুরু হলো আমাদের গান-আড্ডা। প্রীয়মদা দারুন গান গায়, রিমাও কম যায় না। গলা ছেড়ে শুরু হলো একের পর এক রবীন্দ্রসঙ্গীত। এতদিন পর গানের গুঁতোয় আমার গলাও বোধহয় ঘাবড়ে গিয়ে ঠিকঠাক সুরে বাজতে লাগলো। আর আমাদের টীমলিড সুমনদা যে কোডিং আর ফোটোগ্রাফির পরে এরকম গানও গাইতে পারে সেটা আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল! এভাবেই আমরা কোনো গান অর্ধেক, কোনটা গুনগুন, কোনটা বা টেবিল বাজিয়ে সুরে-বেসুরে গাইতে লাগলাম। আহা, কী অপূর্ব সুন্দর সেই সঙ্গীত-বাসর! শুনলে হয়তো খুশি হয়ে যেতেন স্ময়ং ভূতের রাজাও!

হঠাৎ রিমা ধরল “জাগরণে যায় বিভাবরী…”। আমরাও সবাই একসাথে গলা মেলালাম। সেই বিভাবরী আমাদের জাগরণেই কেটেছিল। গান যখন শেষ হলো, তখন সাড়ে ৩টে। রুমে ফিরলাম আমি আর রিমা। অনুষ্কাদি তখনও ঘুমের দেশে। বিছানায় একটু গড়িয়েই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। মোহনায় যেতে হবে তো, Sunrise দেখতে…

(ক্রমশঃ)

*নাম পরিবর্তিত

One Comment Add yours

  1. Tushar says:

    সত্যি, দীঘা নিয়েও এমন লেখা যায় !

    Like

Leave a comment